ইতালি নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পিজ্জা, পাস্তা আর ভেনিসের রোমান্টিক দৃশ্য, তাই না? কিন্তু এই মনোরম দেশটার পেছনে যে লুকিয়ে আছে এক বিশাল আত্মত্যাগ আর স্বাধীনতার গৌরবময় ইতিহাস, সেটা কি আমরা সবাই জানি?
উনিশ শতকে যখন ইতালি ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং বিদেশি শক্তির অধীনে, তখনই শুরু হয়েছিল এক অভাবনীয় জাগরণ, যা ইতিহাসে ‘রিসোর্জিমেন্টো’ নামে পরিচিত। ম্যাৎসিনি, কাভুর, আর গ্যারিবল্ডির মতো কিংবদন্তি নেতারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন একটি ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন ইতালির স্বপ্ন পূরণের জন্য। তাদের সেই অদম্য সাহস, দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর আত্মত্যাগ আজও আমাদের মনে দেশপ্রেমের শিখা জ্বালিয়ে দেয়। চলুন, আজকের লেখায় ইতালির সেই স্বাধীন হওয়ার রুদ্ধশ্বাস গল্পটা আরও বিশদে জেনে নিই।
আহা, ইতালি! নামটা শুনলেই কেমন যেন একটা অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে, তাই না? পিৎজা, পাস্তা, কফি আর অপার সৌন্দর্য্যের এক দেশ। কিন্তু এই আধুনিক, ঐক্যবদ্ধ ইতালির পেছনে যে কত শত বছরের সংগ্রাম আর আত্মত্যাগ লুকিয়ে আছে, সে গল্পটা জানলে আপনিও মুগ্ধ হবেন। আমার তো মনে হয়, আমরা অনেকেই এই বীরত্বগাথার বিস্তারিত জানি না। বিশেষ করে, উনিশ শতকে যখন ইতালি ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং বিদেশি শক্তির অধীনে প্রায় পরাধীন জীবনযাপন করছিল, তখন যে অভূতপূর্ব জাগরণ এসেছিল, যাকে ইতিহাসে ‘রিসোর্জিমেন্টো’ বলা হয়, তা সত্যিই অনুপ্রেরণামূলক। ম্যাৎসিনি, কাভুর, আর গ্যারিবল্ডির মতো অকুতোভয় নেতারা নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে একটি স্বাধীন ইতালির স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। তাদের সেই দেশপ্রেম, অদম্য সাহস আর আত্মত্যাগ আজও আমাদের মনে এক গভীর রেখাপাত করে। আসুন, আজ সেই রুদ্ধশ্বাস যাত্রার আরও কিছু অজানা অধ্যায় আমরা খুঁজে দেখি।
বিদেশি শক্তির শৃঙ্খলে ইতালির বিভাজন

ইতালির ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পাই যে, নেপোলিয়নের আগমনের আগে ইতালি অসংখ্য ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল, আর তার বেশিরভাগই ছিল বিদেশি শাসকদের হাতের পুতুল। ১৮১৫ সালের ভিয়েনা কংগ্রেসের পর, ইতালির এই বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মেটারনিখের মতো ক্ষমতাধর শাসকরা ইতালিকে “একটি ভৌগোলিক অভিব্যক্তি ছাড়া কিছুই নয়” বলে উপহাস করেছিলেন। তার এই মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়, সে সময়ে ইতালির অবস্থা কতটা করুণ ছিল। অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, বুরবোঁ রাজবংশ – নানা বিদেশি শক্তি ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। লোম্বার্ডি ও ভেনেশিয়া ছিল অস্ট্রিয়ার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে, অন্যদিকে পারমা, মডেনা, টুসকানি এবং লাক্কা রাজ্যগুলো অস্ট্রিয়া রাজবংশের বিভিন্ন যুবরাজদের দ্বারা শাসিত হতো। একমাত্র পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার স্যাভয় রাজবংশ ছাড়া বাকি সব রাজ্যেই ছিল বিদেশি শাসনের জগদ্দল পাথর। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মনে স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকলেও, তা প্রকাশ করার কোনো পথ ছিল না। মেটারনিখের দমনমূলক নীতি ইতালির জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বারবার চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আগুনের স্ফুলিঙ্গ কি আর বেশি দিন চাপা থাকে?
এই সময়টা আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব কষ্ট দেয় যখন ভাবি, একটি দেশের মানুষ হয়েও তারা নিজেদের মাটিতে পরাধীন জীবনযাপন করছিল।
মেটারনিখের লৌহ কঠিন শাসন এবং জনগণের বঞ্চনা
মেটারনিখ ছিলেন প্রগতিশীল ভাবধারা, গণতন্ত্র আর উদারনীতির ঘোর বিরোধী। তিনি চেয়েছিলেন পুরো ইউরোপে পুরাতনতন্ত্র আর রক্ষণশীলতা বজায় থাকুক। এর জন্য তিনি ইতালিতে কঠোর দমনমূলক নীতি প্রয়োগ করেন, যা জাতীয়তাবাদী চেতনা আর ঐক্যবদ্ধ ইতালির স্বপ্নকে বারবার নস্যাৎ করে দিচ্ছিল। সাধারণ মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারতো না, নিজেদের অধিকারের জন্য লড়তে পারতো না। এই বঞ্চনা আর নিপীড়নই কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। আমার মনে হয়, যখন কোনো দেশের মানুষ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা আর পরিচয়ের জন্য লড়াই করে, তখন এই ধরনের দমননীতিই উল্টো ফল দেয়। মানুষ আরও বেশি করে একত্রিত হওয়ার পথ খোঁজে। ইতালির ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল। এই অবিচারই যেন স্বাধীনতার বীজ বুনে দিয়েছিল ইতালীয়দের হৃদয়ে।
উগ্র প্রাদেশিকতা: ঐক্যের পথে বড় বাধা
ইতালির বিভাজনের আরেকটি বড় কারণ ছিল উগ্র প্রাদেশিকতা। ছোট ছোট রাজ্যগুলো নিজেদের আঞ্চলিক স্বার্থ নিয়ে এতটাই বিভোর ছিল যে, একটা বৃহত্তর ইতালির ধারণাই তাদের কাছে গৌণ হয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন প্রদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা আর ইতিহাস ছিল, যা তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করত। ফলে, এক প্রদেশ আরেক প্রদেশের বিরুদ্ধে, এক শহর আরেক শহরের বিরুদ্ধে লেগেই থাকত। মেটারনিখের কথায়, “ইতালিতে এক প্রদেশ আরেক প্রদেশের, এক শহর আরেক শহরের, এক পরিবার আরেক পরিবার এবং এক মানুষ আরেক মানুষের বিরুদ্ধে লেগেই রয়েছে।” এই উগ্র প্রাদেশিকতা ইতালির ঐক্য আন্দোলনের পথে এক প্রধান অন্তরায় ছিল। একজন ব্লগার হিসেবে আমি যখন এই বিষয়গুলো পড়ি, তখন মনে হয়, কীভাবে মানুষের মধ্যে এই বিভাজন দূর করে একতাবদ্ধ করা যায়, সেটা ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
জাগরণের প্রথম সুর: কার্বোনারি ও ইয়ং ইতালি
বিদেশি শাসন আর প্রাদেশিকতার অন্ধকারে যখন ইতালি ডুবে যাচ্ছিল, তখনই আলোর দিশারী হয়ে এলেন কিছু দেশপ্রেমিক। তাদের হাত ধরেই শুরু হলো ‘রিসোর্জিমেন্টো’ বা নবজাগরণ। এই জাগরণের প্রথম ধাপ ছিল গোপন সমিতিগুলোর উত্থান। কার্বোনারি ছিল তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ গুপ্ত সমিতি, যা ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমিতির সদস্যরা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বিদেশি শাসন থেকে ইতালিকে মুক্ত করতে চেয়েছিল। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাস, গুপ্তহত্যা আর বিপ্লবের পথে ইতালিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এরপর এলেন এক স্বপ্নদ্রষ্টা যুবক, জোসেফ ম্যাৎসিনি। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, শুধুমাত্র গোপন সমিতি দিয়ে ইতালির স্বাধীনতা আসবে না, এর জন্য চাই যুবশক্তির জাগরণ।
ম্যাৎসিনি ও “ইয়ং ইতালি” – যুবশক্তির মশাল
জোসেফ ম্যাৎসিনি (১৮০৫-১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন ইতালির জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রাণপুরুষ। আমি যখন তার সম্পর্কে পড়ি, তখন আমার মনে হয়, তার মতো একজন মানুষের নেতৃত্বেই একটি জাতি তার আত্মপরিচয় ফিরে পেতে পারে। ম্যাৎসিনি প্রথম দিকে কার্বোনারি দলের সদস্য ছিলেন, কিন্তু পরে তিনি উপলব্ধি করেন যে ইতালির যুবশক্তিকে জাগাতে হবে। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘ইয়ং ইতালি’ বা ‘তরুণ ইতালি’ নামে একটি বিপ্লবী দল গঠন করেন। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল যুবকদের মধ্যে দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়া। ম্যাৎসিনি মনে করতেন, “ঈশ্বর ও জনগণের দ্বারা ইতালি ঐক্যবদ্ধ হবে” এবং ইতালির যুবকরাই তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। তিনি গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ আর ইতালির অতীত গৌরব-কাহিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার লেখনী আর বাগ্মিতা হাজার হাজার ইতালীয় যুবককে স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আমার মনে হয়, একজন মানুষের কথা বলার শক্তি কতটা শক্তিশালী হতে পারে, ম্যাৎসিনি তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি ঐক্যবদ্ধ ইতালীয় প্রজাতন্ত্রের, যা কোনো বিদেশি শক্তির অধীনে থাকবে না। যদিও তার অনেক প্রচেষ্টা প্রাথমিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিল, তবুও তিনি ইতালিবাসীর মনে স্বাধীনতার যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, তা আর নিভে যায়নি। তার এই কাজই ইতালির ভবিষ্যতের পথ খুলে দিয়েছিল।
কার্বোনারি আন্দোলন ও প্রাথমিক গণঅভ্যুত্থান
ম্যাৎসিনি আসার আগে কার্বোনারি সমিতির পরিচালিত আন্দোলনগুলো ইতালি জুড়ে এক ধরনের জাগরণ এনেছিল। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কার্বোনারি ও অন্যান্য গুপ্ত সমিতিগুলোর উদ্যোগে মধ্য ইতালির বিভিন্ন রাজ্যে প্রবল গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। কিন্তু এই আন্দোলনগুলো গণসমর্থন, যোগ্য নেতৃত্ব, উপযুক্ত রাজনৈতিক আদর্শ আর গঠনমূলক পরিকল্পনার অভাবে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতা থেকে ম্যাৎসিনি শিক্ষা নিয়েছিলেন যে, শুধু বিপ্লব নয়, এর পেছনে একটি সুসংগঠিত আদর্শ আর শক্তিশালী যুবশক্তির প্রয়োজন। আমি যখন ইতিহাসের এই অধ্যায়টি পড়ি, তখন আমার মনে হয়, কোনো বড় পরিবর্তন রাতারাতি আসে না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আর অদম্য দৃঢ়তা।
কূটনীতির জাদুকর: কাভুরের চতুর চাল
ম্যাৎসিনির পর ইতালির ঐক্য আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন কাউন্ট ক্যামিলো বেনসো ডি ক্যাভুর (১৮১০-১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ)। তাকে ইতালির ঐক্য আন্দোলনের মস্তিষ্ক বা স্থপতি বলা হয়। আমি যখন ক্যাভুরের কূটনীতি নিয়ে পড়ি, তখন আমার মনে হয়, তিনি একজন সত্যিকারের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন!
তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, বিদেশি শক্তির সাহায্য ছাড়া অস্ট্রিয়ার মতো প্রবল শক্তিকে ইতালি থেকে বিতাড়িত করা সম্ভব নয়। তাই তিনি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়াকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দেন এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির ময়দানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তার লক্ষ্য ছিল পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার স্যাভয় বংশের নেতৃত্বে ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করা।
পিঁয়মন্টের উত্থান ও সংস্কারের ধারা
ক্যাভুর প্রথমে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়াকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী করেন। তিনি রাজ্যে নতুন মুদ্রা সংস্কার, কুটির শিল্পের উন্নতি, ঋণদান, ব্যাংক, বীমা সংস্থা গড়ে তোলেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও সামরিক সংস্কারের মাধ্যমে তিনি রাজ্যের চেহারা বদলে দেন। রেলপথ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে দেশের প্রাদেশিক সংকীর্ণতা দূর হয় এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিকশিত হতে থাকে। ঐতিহাসিক থমসন বলেছেন, ক্যাভুরের অর্থনৈতিক সংস্কারগুলো তার রাজনৈতিক সাফল্যের মূল ভিত্তি ছিল। আমার মনে হয়, একজন যোগ্য নেতা শুধু স্লোগান দেন না, বরং দেশের ভিতরের কাঠামোকেও মজবুত করেন, যা ক্যাভুর অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে করেছিলেন।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইতালির সমস্যা উত্থাপন
ক্যাভুর তার আদর্শ অনুযায়ী পিডমন্ট-সার্ডিনিয়াকে শক্তিশালী করার পর আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইতালির সমস্যা তুলে ধরার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (১৮৫৪-১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) শুরু হলে তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইঙ্গ-ফরাসি পক্ষে যোগদান করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সহানুভূতি লাভ করা। যুদ্ধের পর প্যারিসের শান্তি বৈঠকে (১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি ইতালির সমস্যা তুলে ধরেন এবং ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সহানুভূতি লাভে সক্ষম হন। এভাবেই ইতালীয় সমস্যা আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়। এই ঘটনা সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করে। একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ কীভাবে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে নিজের দেশের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেন, ক্যাভুর তার এক দারুণ উদাহরণ।
রণাঙ্গনের কিংবদন্তি: গ্যারিবল্ডির দুঃসাহসিক অভিযান
ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ম্যাৎসিনি আর ক্যাভুরের পাশাপাশি আরেকজন কিংবদন্তি ছিলেন – জিউসেপ গ্যারিবল্ডি (১৮০৭-১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দ)। তাকে বলা হয় “ইতালির স্বাধীনতা আন্দোলনের সিংহহৃদয় বীর”। আমি যখন গ্যারিবল্ডির দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প শুনি, তখন মনে হয় যেন কোনো সিনেমার চরিত্র!
১৮৩৩ সালে তিনি ম্যাৎসিনির সংস্পর্শে এসে ‘ইয়ং ইতালি’ দলের সদস্য হন এবং স্যাভয়-এর বিদ্রোহে যোগ দিলে তার প্রাণদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হন। কিন্তু দেশপ্রেমিকের মন কি আর দেশে না ফিরে থাকতে পারে?
লাল কোর্তা বাহিনীর বিজয়গাথা
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ইতালিতে বিপ্লব শুরু হলে গ্যারিবল্ডি ইতালিতে ফিরে আসেন এবং রোমে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ম্যাৎসিনির অন্যতম সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তবে তার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল “লাল কোর্তা” (Redshirts) নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সেনাদল গঠন করে দক্ষিণ ইতালির সিসিলি ও নেপলস অভিযান। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিসিলি ও নেপলস জয় করেন এবং সেখানকার বুরবোঁ রাজবংশকে পরাজিত করেন। এই অভিযান ছিল এক অভাবনীয় সাফল্য। কল্পনা করুন তো, মাত্র এক হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে তিনি দুটি বিশাল রাজ্য জয় করে ফেললেন!
তার এই বীরত্ব ইতালীয় জনগণের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার করেছিল। এই ঘটনাটি সত্যিই আমার মনে গভীর প্রভাব ফেলে, কারণ এটি প্রমাণ করে যে, দৃঢ় সংকল্প আর সাহসিকতা থাকলে যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়।
গ্যারিবল্ডির মহান আত্মত্যাগ

সিসিলি ও নেপলস জয়ের পর গ্যারিবল্ডি সেখানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। কিন্তু ক্যাভুর উপলব্ধি করেন যে, ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ এই প্রজাতন্ত্র মেনে নেবে না এবং এতে ইতালির ঐক্যের ক্ষতি হবে। ক্যাভুর তাই পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার রাজা ভিক্টর ইমান্যুয়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দেশপ্রেমিক গ্যারিবল্ডি যুদ্ধ এড়িয়ে সিসিলি ও নেপলস রাজা ভিক্টর ইমান্যুয়েলের হাতে তুলে দেন এবং নিজে ক্যাপেরেরা দ্বীপে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। তার এই আত্মত্যাগ আমাকে আজও মুগ্ধ করে। নিজের ব্যক্তিগত স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া – এ সত্যিই এক বিরল দৃষ্টান্ত। তার এই ত্যাগের ফলেই রাজ্যটি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ইতালির ঐক্য আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়।
| নেতা | ভূমিকা | পরিচিতি |
|---|---|---|
| জোসেফ ম্যাৎসিনি | জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, ইয়ং ইতালি প্রতিষ্ঠা | ইতালির আত্মার প্রতীক (Soul of Italy) |
| কাউন্ট ক্যামিলো ডি ক্যাভুর | কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক কৌশল, পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার শক্তিশালীকরণ | আধুনিক ইতালির স্রষ্টা (Architect of Modern Italy) |
| জিউসেপ গ্যারিবল্ডি | সামরিক নেতৃত্ব, লাল কোর্তা বাহিনী দ্বারা দক্ষিণ ইতালি বিজয় | ইতালির স্বাধীনতা আন্দোলনের সিংহহৃদয় বীর (Hero of Two Worlds) |
| ভিক্টর ইমান্যুয়েল দ্বিতীয় | ঐক্যবদ্ধ ইতালির প্রথম রাজা, পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার নেতৃত্ব | ঐক্যের প্রতীক ও প্রথম সংবিধানিক রাজা |
ঐক্যের পথে বাধা ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম
ইতালির ঐক্য শুধু তিন মহান নেতার একক প্রচেষ্টায় আসেনি, এর পেছনে ছিল দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। অস্ট্রিয়ার মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে হারানো সহজ ছিল না। ইতালির ঐক্য আন্দোলনে বিদেশি শক্তির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নেপোলিয়নের শাসনের সময় থেকেই ইতালীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বীজ বপন হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে জাগরণে পরিণত হয়। ১৮৪৮ সালের বিপ্লবগুলো ইতালির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল। এই সময় ইতালি জুড়ে নানা স্থানে বিদ্রোহ শুরু হয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল অস্ট্রিয়ার শাসন থেকে মুক্তি এবং উদারনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা। এই বিপ্লবগুলো যদিও প্রাথমিকভাবে ব্যর্থ হয়, তবে তা ভবিষ্যতের পথ তৈরি করে দিয়েছিল। আমি যখন এই সংগ্রামের কথা ভাবি, তখন মনে হয়, একটি জাতি তার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কতটা কঠিন পথ পাড়ি দিতে পারে।
প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তার প্রভাব
১৮৪৮ সালের বিপ্লব ইতালিতে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা করে। চার্লস আলবার্ট, যিনি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার রাজা ছিলেন, পোপ নবম পিয়াসের সমর্থন নিয়ে ইতালিকে একত্রিত করার চেষ্টা করেন। লোম্বার্ডি-ভেনেশিয়াতে, বিশেষ করে মিলানে, অস্ট্রিয়ান জেনারেল রাডেৎস্কিকে কোয়াড্রিল্যাটারাল দুর্গে পিছু হটতে বাধ্য করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। এই যুদ্ধ ইতালীয়দের মনে দেশপ্রেমের আগুন আরও তীব্র করে তুলেছিল। যদিও পরাজয় এসেছিল, কিন্তু এই পরাজয়ই ছিল ভবিষ্যতের বিজয়ের বীজ। আমার মনে হয়, যেকোনো বড় অর্জনের আগে কিছু ব্যর্থতা আসে, যা আমাদের আরও শক্তিশালী করে তোলে।
ক্যাভুরের কূটনীতি এবং ফ্রান্সের ভূমিকা
ক্যাভুরের বিচক্ষণ কূটনীতির ফলেই ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ফ্রান্সের মতো একটি পরাশক্তির সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ক্যাভুর এবং ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন প্লোমবিয়ার্স নামক স্থানে এক গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হন, যা প্লোমবিয়ার্সের চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তির মাধ্যমে স্থির হয় যে, ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ফ্রান্স পিডমন্টকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে, তবে অস্ট্রিয়াকে প্রথম আক্রমণ করতে হবে। এর বিনিময়ে ফ্রান্স স্যাভয় ও নিস পাবে। ক্যাভুর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অস্ট্রিয়াকে উস্কানি দেন এবং ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়া পিডমন্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ফ্রান্সও যুদ্ধে যোগ দেয়। ম্যাজেন্টা ও সলফেরিনোর যুদ্ধে অস্ট্রিয়া পরাজিত হয় এবং লোম্বার্ডি পিডমন্টের দখলে আসে। এই কূটনৈতিক জয় ইতালির ঐক্যের পথকে অনেকটাই সুগম করে তুলেছিল।
রোম দখল ও পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার সূর্যোদয়
ইতালির একীকরণ প্রক্রিয়া একটি দীর্ঘ এবং জটিল যাত্রা ছিল, যা ১৮৬১ সালে ইতালীয় রাজ্যের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জন করে। কিন্তু তখনও ভেনেশিয়া এবং রোম ইতালির অংশ হয়নি। আমার মনে হয়, কোনো বড় লক্ষ্য অর্জনের শেষ ধাপগুলো সবসময় সবচেয়ে কঠিন হয়, আর ইতালির ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল। এই দুটি অঞ্চলকে ইতালির সাথে যুক্ত করাই ছিল চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ।
ভেনেশিয়া ইতালির অংশ হলো
১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে স্যাডোয়ার যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে অস্ট্রিয়া পরাজিত হলে ভেনেশিয়া ইতালির অন্তর্ভুক্ত হয়। এই ঘটনা ইতালির জন্য ছিল এক বিশাল বিজয়। আমি যখন ইতিহাসের এই বাঁকগুলো পড়ি, তখন মনে হয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট কীভাবে একটি দেশের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। ক্যাভুরের সেই দূরদৃষ্টিই ইতালির জন্য এই সুযোগ তৈরি করেছিল। ভেনেশিয়াকে ইতালির সাথে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে ইতালির মানচিত্র অনেকটাই পূর্ণতা পায়।
রোম: ইতালির চূড়ান্ত লক্ষ্য
ঐক্যবদ্ধ ইতালির জন্য রোমকে রাজধানী করা অপরিহার্য ছিল, কারণ রোমের ছিল এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্য এবং এটি ছিল রোমান সভ্যতার কেন্দ্রস্থল। কিন্তু রোম তখন পোপের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং ফরাসি সৈন্যদের দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। ১৮৭০ সালে ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়ান যুদ্ধ শুরু হলে ফরাসি সৈন্যরা রোম থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ইতালীয় সৈন্যরা রোম দখল করে এবং ১৮৭১ সালে রোমকে ঐক্যবদ্ধ ইতালির রাজধানী ঘোষণা করা হয়। এভাবেই ইতালির বহু আকাঙ্ক্ষিত ঐক্য সম্পূর্ণ হয়। আমার মনে হয়, যখন একটি জাতি তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে, তখন তার আনন্দ কতটা গভীর হতে পারে!
ইতালির ঐক্য ছিল শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক বিজয় নয়, বরং এটি ছিল জাতীয়তাবাদী চেতনার এক ঐতিহাসিক সাফল্য।
ইতালির ঐক্য: এক নতুন ভোরের সূচনা
১৮৭১ সালে রোম ইতালির সাথে একীভূত হওয়ার পর, ইতালির ঐক্য প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয় এবং একটি নতুন ইতালির জন্ম হয়। এই সময়কে সত্যিই একটি নতুন ভোরের সূচনা বলা যায়। এতদিন ধরে ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত, বিদেশি শাসনে জর্জরিত একটি দেশ অবশেষে নিজেদের পরিচয় নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল। আমার মনে হয়, এর চেয়ে বড় গর্বের মুহূর্ত আর কী হতে পারে!
এই ঐক্য কেবল ভৌগোলিক একীকরণ ছিল না, বরং এটি ইতালীয় জনগণের মধ্যে এক নতুন আত্মবিশ্বাস আর জাতীয়তাবোধের জন্ম দিয়েছিল।
ঐক্যবদ্ধ ইতালির প্রথম রাজা: ভিক্টর ইমান্যুয়েল দ্বিতীয়
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ভিক্টর ইমান্যুয়েল দ্বিতীয়কে ঐক্যবদ্ধ ইতালির প্রথম রাজা ঘোষণা করা হয়। তিনি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার রাজা হিসেবে ইতালির ঐক্য আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং ক্যাভুরের সাথে তার বোঝাপড়া ইতালির ঐক্যকে সম্ভব করে তুলেছিল। তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ শাসক যিনি দেশের স্থিতিশীলতা ও উন্নতির জন্য কাজ করেছেন। তার নেতৃত্বে ইতালি একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করে। একজন ব্লগার হিসেবে আমি মনে করি, একজন যোগ্য রাজার অধীনে একটি জাতি কতটা এগিয়ে যেতে পারে, ভিক্টর ইমান্যুয়েল দ্বিতীয় তার প্রমাণ।
ঐক্যের ফল এবং ভবিষ্যতের ইতালির ভিত্তি স্থাপন
ইতালির ঐক্য শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে ইতালি শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্যে উন্নতি করার সুযোগ পায়। শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিকীকরণ হয় এবং একটি অভিন্ন জাতীয় পরিচয় গড়ে ওঠে। যদিও এই ঐক্যের পরেও আঞ্চলিক পার্থক্য এবং কিছু চ্যালেঞ্জ থেকেই গিয়েছিল, তবে রিসোর্জিমেন্টো ইতালির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এই সময়টা থেকেই আধুনিক ইতালির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। আমি যখন ইতালির এই পরিবর্তন দেখি, তখন আমার মনে হয়, ঐক্যবদ্ধ শক্তি কতটা শক্তিশালী হতে পারে, যা একটি দেশকে একেবারে বদলে দিতে পারে। এই একীকরণই ইতালির আজকের অবস্থানে আসার পথ তৈরি করে দিয়েছে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ) 📖
প্র: রিসোর্জিমেন্টো আসলে কী ছিল?
উ: রিসোর্জিমেন্টো, এই ইতালীয় শব্দটার মানে জানো তো? ‘পুনরুত্থান’ বা ‘পুনর্জন্ম’। ভাবতে অবাক লাগে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইতালি আজকের মতো একটা ঐক্যবদ্ধ দেশ ছিল না। এটা ছিল অসংখ্য ছোট ছোট রাজ্য আর বিদেশি শক্তির অধীনে থাকা একটা ভৌগোলিক ধারণা মাত্র। অস্ট্রিয়া, ফ্রান্সের মতো দেশগুলো ইতালির বিভিন্ন অংশ শাসন করত। রিসোর্জিমেন্টো ছিল আসলে সেই সময়কার একটা বিশাল রাজনৈতিক, সামাজিক আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যার মূল লক্ষ্য ছিল ইতালিকে এই বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত করে একটা স্বাধীন, ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে তোলা। এটা শুধু একটা যুদ্ধ ছিল না, ছিল ইতালীয় জনগণের আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়ার, নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার একটা মহাযাত্রা। আমার মনে হয়, এই সময়টা ইতালীয়দের জীবনে একটা নতুন আলোর দিশা দেখিয়েছিল, ঠিক যেমন একটা জাতির জন্য তার স্বাধীনতা কতটা জরুরি, সেটা আমাদের দেশের ইতিহাসও মনে করিয়ে দেয়।
প্র: ইতালির ঐক্য আন্দোলনে মূল নায়কেরা কারা ছিলেন এবং তাদের ভূমিকা কেমন ছিল?
উ: ইতালির ঐক্য আন্দোলনের গল্পটা কিছু কিংবদন্তি মানুষের আত্মত্যাগ আর দূরদর্শিতা ছাড়া অসম্পূর্ণ। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, এই তিনজনের অবদান ইতালির স্বাধীনতার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল:জোসেফ ম্যাৎসিনি (Giuseppe Mazzini): উনি ছিলেন ইতালীয় জাতীয়তাবাদের ‘আত্মা’ বা ‘ঋষি’। ম্যাৎসিনি একজন দার্শনিক, লেখক আর বিপ্লবী ছিলেন, যিনি যুবকদের মধ্যে স্বাধীনতার আগুন জ্বালিয়েছিলেন। ১৮৩১ সালে তিনি ‘ইয়ং ইতালি’ (Young Italy) নামে একটা গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইতালিতে একটা গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর লেখায়, বক্তৃতায় তিনি ইতালীয়দের মনে দেশপ্রেম আর ঐক্যের বীজ বুনে দিয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল বিদেশি শাসনমুক্ত একটা ঐক্যবদ্ধ ইতালি, যেখানে সবার সমান অধিকার থাকবে। ম্যাৎসিনিকে পড়লে আমার মনে হয়, তিনি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন, যিনি মানুষকে একটা বৃহত্তর লক্ষ্যের জন্য অনুপ্রাণিত করতে জানতেন।
কাউন্ট ক্যামিলো ডি ক্যাভুর (Count Camillo di Cavour): ক্যাভুর ছিলেন পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার প্রধানমন্ত্রী, যাকে ইতালির ঐক্য আন্দোলনের ‘মস্তিষ্ক’ বলা হয়। ম্যাৎসিনি যেখানে বিপ্লবের মাধ্যমে পরিবর্তনের কথা বলতেন, সেখানে ক্যাভুর ছিলেন একজন বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ, যিনি কূটনীতি আর কৌশল দিয়ে ইতালিকে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি বিদেশি শক্তি, বিশেষ করে ফ্রান্সের সমর্থন আদায় করে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার পথ তৈরি করেন। আমার তো মনে হয়, ক্যাভুরের মতো একজন বিচক্ষণ নেতা না থাকলে হয়তো ইতালির ঐক্য আরও কঠিন হয়ে যেত, কারণ তিনি জানতেন কখন কাকে পাশে টানতে হবে।
জুসেপ্পে গ্যারিবল্ডি (Giuseppe Garibaldi): গ্যারিবল্ডি ছিলেন ইতালির ঐক্য আন্দোলনের ‘তরবারি’ বা ‘বীর সৈনিক’। তাঁর ‘লাল শার্ট’ বাহিনী নিয়ে তিনি দক্ষিণ ইতালিতে একের পর এক বিজয়ের মাধ্যমে নেপলস আর সিসিলি দখল করেন, যা ইতালির একীকরণের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছিলেন একজন অদম্য সাহসী গেরিলা নেতা। গ্যারিবল্ডির অভিযানগুলোর কথা পড়লে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তাঁর মতো একজন নির্ভীক যোদ্ধা, যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য লড়েছেন, সত্যি বলতে কী, খুব কমই দেখা যায়।এই তিনজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই ইতালি ১৮৬১ সালে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজ্যে পরিণত হয়, যদিও রোম পরে ১৮৭০ সালে যুক্ত হয়েছিল।
প্র: এত বড় একটা দেশ একত্রিত করতে কী কী বাধা এসেছিল বলে তুমি মনে করো?
উ: ইতালির মতো একটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না, যেন একটা জটিল ধাঁধার সমাধান করার মতো। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যখন আমরা কোনো বড় কাজ হাতে নিই, ছোট ছোট অনেক বাধাই পাহাড়ের মতো মনে হয়, আর এটা তো ছিল একটা পুরো দেশ একত্র করার ব্যাপার!
বিদেশি শক্তির আধিপত্য: সবচেয়ে বড় বাধা ছিল অস্ট্রিয়া আর ফ্রান্সের মতো বিদেশি শক্তিগুলোর আধিপত্য। ভিয়েনা সম্মেলনের পর ইতালিকে অনেকগুলো ছোট ছোট রাজ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল, আর বেশিরভাগই ছিল বিদেশি শাসকদের অধীনে। এই বিদেশি শক্তিগুলো চাইত না ইতালি এক হয়ে শক্তিশালী হোক, কারণ তাতে তাদের প্রভাব কমে যেত। এটা ঠিক যেন, পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে ঝামেলা লাগিয়ে দিয়ে নিজের সুবিধা আদায় করার মতো!
আভ্যন্তরীণ বিভেদ আর অনৈক্য: ইতালির ভেতরের রাজ্যগুলোর মধ্যেও ঐক্য ছিল না। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, এমনকি রাজনৈতিক আদর্শেও অনেক পার্থক্য ছিল। কেউ চাইত প্রজাতন্ত্র, কেউ চাইত রাজতন্ত্রের অধীনে ঐক্য। ম্যাৎসিনি যেমন প্রজাতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতেন, আবার ক্যাভুর পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার রাজতন্ত্রের অধীনে ঐক্য চাইতেন। এই যে মতপার্থক্য, এটা আন্দোলনের গতিকে বারবার স্লথ করে দিত।
পোপের রাজ্য (Papal States): রোমের পোপের নিজস্ব রাজ্য ছিল, আর পোপ ইতালির একীকরণের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর ভয় ছিল, এতে তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা আর প্রভাব কমে যাবে। পোপের এই অবস্থান ইতালীয় জাতীয়তাবাদীদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, কারণ ইতালীয়রা বেশিরভাগই ক্যাথলিক ছিলেন এবং পোপের প্রতি তাদের গভীর শ্রদ্ধা ছিল। এই ব্যাপারটা অনেকটা ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার সংঘাতের মতো ছিল।
অর্থনৈতিক বৈষম্য: ইতালির উত্তর আর দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থার অনেক ফারাক ছিল। উত্তরাঞ্চল ছিল বেশি উন্নত আর শিল্পোন্নত, অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চল ছিল কৃষিপ্রধান আর দরিদ্র। এই অর্থনৈতিক বৈষম্যও একীকরণ প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছিল।এতসব বাধা পেরিয়ে ইতালি যে শেষ পর্যন্ত এক হতে পেরেছিল, সেটাই তো এই কাহিনীর সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ক অংশ। আমার মনে হয়, এর থেকে আমরা শিখতে পারি যে দৃঢ় সংকল্প আর আত্মত্যাগ থাকলে যেকোনো কঠিন লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।






